বাড়বকুণ্ড ট্রেইল( Barobkunda trail)

বাড়বকুণ্ড ট্রেইল

বাংলাদেশের একমাত্র উষ্ণ পানির প্রশ্রাবন, যেখানে  পানিতেও আগুন জ্বলে। এইখানে  আছে শত শত বছরের পুরনো সব মন্দির। আছে ঝিরি পথ, পাহাড় ও ঝর্ণা। বলছিলাম বাড়বকুণ্ড ট্রেইল এর কথা। সীতাকুণ্ডে একমাত্র গরম পানির ঝর্ণা আপনি এইখানেই পাবেন।

যাবার আগে অবশ্যই দেখে যাবেন

🔰https://youtu.be/LkVe4kQt3I0

কিভাবে যাবেন? 

বাড়বকুণ্ড বাজার পেরিয়ে ৫ মিনিট হাটলেই। পীচঢালা রাস্তার শেষ, পাহাড়ি পথের শুরু!  পাহাড়ি বনের বুক চীরে চলে গেছে মৃদু কর্দমাক্ত পথ। পথ ধরে হাটা শুরু করলেই৷ আশপাশের পাহাড়গুলো ক্রমশ উঁচু হতে থাকে, বন যেন ঘন হয়ে ওঠে আর নীরবতা ক্ষনে ক্ষনে বাড়তে থাকে। বৃদ্ধি পায় পাহাড়ের অচেনা এক অন্য রকম প্রকৃতির ডাক। করাত দিয়ে শুকনো গাছ কাটার শব্দের মতো ঝিঝি পোকার ডাক। অচেনা সব পাখির অদ্ভুত সুন্দর করে ডেকে ওঠা। আর পদতলে পৃষ্ট হতে থাকা শুকনো পাতার দুমড়ে-মুচড়ে ওঠার শব্দ।  যদিও তা বর্ষার বৃষ্টি শব্দের সাথে মিলে মিশে একাকার। আর পথের মাঝে ফুটে থাকা শত শত ঝুমকো জবা সহ অসংখ্যা নাম না জানা পাহাড়ি ফুল।


গহীন পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা এ পথ শেষ হয়েই হঠাৎ দেখা মেলে বর্ষায় প্রাণবন্ত,  অস্থির বেগে ছুটে চলা এক ঝিরিপথের।  ঝিরিপথের আশেপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় প্রতি বর্ষাতেই এ ঝিরিপথ পূর্ণ যৌবন পেয়ে সগৌরবে বড় বড় গাছের কান্ড ভাসিয়ে নিয়ে পাহাড়ের বুকে এক ঝড় তুলে বয়ে চলে! ঝিরি ছেড়ে কিছু পথ হাটলেই দেখা মেলে বৃত্তাকার এক পাহাড়ের। নাম তার কাড়াখাম্বা পাহাড়। ঝিরিপথ বাক নিয়ে বয়ে চলে যাওয়া পেড়িয়ে আরকটু  সামনে গেলেই দেখা মেলে মাঝারি উঁচু এক পাহাড়ি পথে কে যেন সিঁড়ি তৈরি করে উপরে ওঠার রাস্তা করে দিয়েছেন।


সেই সিঁড়ি পথ ধরে উপরে উঠতেই দেখা মিলে এক অদ্ভুত স্থাপনার। প্রায় কয়েকশত বছরের পুরনো কতোগুলো মন্দির। বহু বছরের ইতিহাস বয়ে বেড়ানো শীর্ণজীর্ণ মন্দিরের দেয়াল, ইট-সুড়কি দেখে ধারণা করা যায় মোটামুটি ৩০০-৪০০ বছর আগের স্থাপনা এটি। এর নির্মাণশৈলী কিছুটা মোগলদের মতো। গহীন এ পাহাড়ের ভেতর এমন পুরনো মন্দির গুলো যেন এক অদ্ভুত  রূপ আর ভয়ংকর পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। একেই যেন বলে ভয়ংকর সুন্দর। 


এখানে আছে মূলত অগ্নিকুণ্ড, রাধাকৃষ্ণ, কালভৈরব সহ আরও অনেক গুলো মন্দির। জনমানবহীন পাহাড়ঘেরা এই স্থানই হয়তো গা ছমছম পরিবেশের প্রকৃত উদাহরণ।   দ্বিতল অগ্নিকুন্ড মন্দিরের সিঁড়ি ধরে নামলে মাটির নিচে দেখা মেলে জলের উপুর জ্বল-জ্বল করে জ্বলতে থাকা আগুনের। এখানে কূপ একটাই। কিন্তু দু’পাশে দু’রকম পানি। একপাশের পানিতে ক্রমাগত বুঁদ বুঁদ উঠছে আর বেশ ঠান্ডা। অন্যপাশের পানি নিয়েই যত চাঞ্চল্য, দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। গরমের কারণে কাছে দাঁড়ানো মুশকিল। কিন্তু সেই জল হাতে নিলে আগুনের তাপ লাগেনা। বিষয়টা যেমন অবাক করার মতো, অনেকে আবার মজাও পান।


সনাতম ধর্মাবলম্বীদের কাছে বাড়বকুণ্ড তীর্থ থামের এই অগ্নিকুণ্ড খুবই পবিত্র স্থান। তাদের মতে এই জলে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের সম্ভবনা অলৌকিক ভাবে বেড়ে যায়। কিন্তু প্রচলিত মিথগুলো শুনলে চমকে ওঠেন বেশিরভাগ মানুষই। বাড়বকুণ্ড ট্রেইলে কয়েকশ’ বছরের পুরনো কালভৈরবী মন্দিরের ঠিক পাশেই এই অগ্নিকুণ্ডের অবস্থান। অনেকের মতে, হাজার বছরেরও পুরনো এটি। কিন্তু এই কূপের পানিতে আগুন জ্বলার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক রকমের উত্তর মেলে। অনেকের মতে এটি অভিশপ্ত একটি কূপ, কেউ কেউ বলেন এটি প্রাকৃতিক কারণ।


জায়গাটি নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় জনশ্রুতি হলো, প্রাচীনকালে এখানে দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে নর বলি দেয়া হতো। এভাবে চলতে চলতে একদিন এখানে আগুন ধরে যায়। নরবলি রোধ করতেই যেন দেবতা কর্তৃক এর সৃষ্টি।  অনেক চেষ্টার পরও এই আগুন নেভানো যায়নি। যুগ যুগ ধরে এটি যেন মৃত আগ্নেয়গিরির মুখ; যার ভেতর থেকে সর্বদা আগুন বের হচ্ছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতানুযায়ী, এটা ধর্মীয় আশীর্বাদ। এই মন্দির দেখভাল করা পুরোহিতের মতে যদিও এটি ৫১ টি সতীপিট বা শক্তি পিটের মধ্যে একটি। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে সতী পিঠ বা শক্তি পিঠ কি। মূলত দেবতা শিবের প্রথমা স্ত্রী ছিলেন পার্বতী। পার্বতীর বাবা দেবতা শিবকে অপমান করলে, স্বামীর অপমানে রাগে দুঃখে দেহ ত্যাগ করেন পার্বতী। স্ত্রীর দেহত্যাগে রাগে ক্ষোভে তার দেহ নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন শিব। তখন তার প্রলয় নৃত্যতে জগৎ ধ্বংসের উপক্রম হলে সকল দেবতাদের অনুরোধে জগৎ পালক বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দারা পার্বতীর দেহ খন্ড বিখন্ড করে দেয়। মূলত ৫১ খন্ডে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর নানান দেশের ৫১ টি স্থানে পরে সেই দেহ। আর সেই ৫১ টি পরা স্থানই হয়ে ওঠে ৫১ টি শক্তি পিঠ। এই অগ্নিকুণ্ড আসলেই সতী পিঠ হয়তো নয়। কারন প্রচলিত মত অনুযায়ী অত্র অঞ্চলের সতী পিট হলো সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে গড়ে ওঠা মন্দিরটি। যেখানে আছে কিনা পার্বতীর ডান হাত।


দেশবাসী যাদুটোনা ও মন্ত্র তন্ত্রের জন্য বিখ্যাত কামরুপকামাক্ষা টেম্পেল ও কিন্তু একটি সতী পিঠ। যেটাও ৫১ টি সতী পিঠের একটি। আর সেখানে আছে স্বতীর জোনি। আর মূলত তারি পূজা করা হয় সেখানে।


বাড়বকুণ্ড মন্দিরে উঠার সিঁ‌ড়ির পাশে তেতুল গাছের নিচে দধি ভৈরব অবস্থিত (বর্তমানে তেতুল গাছটি নেই)। এটি একটি গোলাকৃতির শিলাখণ্ড। এর উপরের দিকে একটি গর্ত আছে যেখানে দুধ দিলে তা নিমিষেই দই-এ পরিণত হয়। এই কারনেই একে দধি ভৈরব বলে।


বিখ্যাত অগ্নিকুণ্ড দেখে চলে যেতে পারেন  ঝর্ণা দেখতে। এই ট্রেইলে মূলত ৩ টি ঝর্নাও আছে। মন্দিরের গেইট থেকে থেকে নেমে  হাতের বাম দিকে একটি খুম পাবেন,ঠিক তার পাশ ঘেষেই যে ঝিরিপথ আছে তা ধরে ২০-২৫ মিনিট হাটলেই প্রথম ঝর্না । ঝিরিপথ ধরে এগোলেই বাকি ঝর্না গুলো পেয়ে যাবেন। বিশেষ করে শেষ ঝর্নাটার কথা বলতেই হয়, সেটা পর্যন্ত যেতে ধৈর্য থাকার অতি প্রয়োজন। সেটি দেখার পর আপনার দেহের সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যাবে আশা করি।


ঝিরির পথ চলে চলতে চলতে, বলি বিখ্যাত অগ্নিকুণ্ড নিয়ে বলা বিজ্ঞানের কথা। যতদূর জানা গেছে,  এই কাড়াখাম্বা পাহাড়ে ব্রিটিশ মিথেন গ্যাসের সন্ধ্যান পাওয়া গিয়েছিল। কোনো এক কারণে সেসময় গ্যাস কূপের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয় সীসা দিয়ে। তারপর থেকে অগ্নিকুন্ডের এখানকার পানিতে আগুন জ্বলে। বৈজ্ঞানিক বা প্রচলিত মত যাই হোকনা কেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, এর পাশে দাঁড়ালে গা ছমছমে ব্যাপার কাজ করে! মনে হবে কোনো এক অভিশপ্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন আপনি।


ঝরনায় যেভাবে যাবেনঃ

 বাড়বকুণ্ড ট্রেইল অপরিচিত হওয়ার কারনে অনেকেই এখানে যায় না ,অথচ এই ট্রেইল ঘুড়ার জন্য বেশ ভাল একটি প্লেস। এখানে আসার সব থেকে সহজ উপায় হলো ঢাকা হতে চট্রগ্রাম গামী বাসে আসা। বাস থেকে নেমে পরবেন বাড়বকুন্ড স্টেশনের কাছেই। সেখান থেকে মাত্র ৫-৭ মিনিটের পায়ে হাটার পাকা পথ পেরিয়ে শুরু পাহাড়ি ট্রেকিং এর পথ।  ফেরার সময় চট্রগ্রাম হতে বাসে বা ট্রেনে ফিরতে পারেন। বাড়বকুন্ড বাজার হতে ১৭ নাম্বার গাড়িতে ৪০-৫০ টাকায় পৌছে যাবেন  অলংকার মোড় বাস স্ট্যান্ডে।

কোথায় খাবেন? 

বাড়বকুণ্ড বাজারের কিছু হালকা মানের হোটেল আছে সেখানে করতে পারেন সকালের নাস্তা কিংবা দুপুরের লাঞ্চ।


সতর্কতা ও সাবধানতাঃ

ট্রেকিং এর এই পথ ধরে যেতে যেতে জোঁকের দেখা মিলতে পারে তাই সাথে লবন অথবা সরিষার তেল নিতে পারেন। পাহাড়ি পিচ্ছিল পাথুরে পথ হলেও আশে পাশের পাহাড় গুলো কিন্তু পাথুরে নয়। দেখা পাথর মনে হলেও সাবধান। একটু চাপেই কিন্তু ধ্বসে পরে পাহাড়ের মাটি। তুলনা মূলক সহজ পথ হলেও বর্ষায় এক প্রকার ভয়ংকর এই ঝিরি পথ।  পাহাড়ে যারা ঘুরাঘুরি করেন তারা জানেন পাহাড় যেমন সুন্দর তেমনি বিপদজনক এক জায়গা। পাহাড়ি ঝিরি গুলো যে কোন সময় হয়ে উঠতে পারে মরন ফাঁদ। বর্ষায় শুধু পাহাড় ধ্বস একমাত্র বিপদ নয় পাহাড়ি ঝিরিরতে তার থেকেও বড় বিপদ হলো ফ্লাস ফ্লাড বা হরকা বান। পাহাড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েই হঠাৎ নেমে আসতে পারে প্রবল বেগে প্রচুর পানির স্রোত।  যা বড় বড় পাথরের বোল্ডা, ও গাছ পালাকে পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পাহাড়ি পথে ছোট ছোট খুম ও ঝর্নার গুলোও বিপদজনক। পিচ্ছিল পথের সাথে সাথে গভীরতা সম্পর্কে ধারনা অনেক সময়ই ভুল হয়ে যায় এখানে। একটা কথা মনে রাখবেন পাহাড়ি ঝিরির সামান্য হাটু পানিও ডেকে আনতে পারে বিপদ। আর তাই প্লিজ লাগে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া বর্ষার অন্তত পাহাড়ে ও ঝিরিতে আসবেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ