মাদাগাস্কার
ভারত মহাসাগরের মাঝে আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপ মাদাগাস্কার ।এই দ্বিপটি শুধু ভোগলিক ভাবেই বিচ্ছিন্ন নয় এর জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটাই আলাদা।মাদাগাস্কারের প্রায় 90 শতাংশ উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই দ্বীপটি পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এবং অসুখী দেশ ।
পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে মানুষ সর্বশেষ বসতি স্থাপন করেছে
মাদাগাস্কার তার মধ্যে অন্যতম।ধারণা করা হয় পৃথিবীতে মানব বসতির প্রায় 3 লক্ষ বছর পর মানুষ এই দ্বীপটি খুঁজে পেয়েছে।খ্রিস্টের জন্মের আগে এখানে মানব বসতির কিছু আলামত পাওয়া যায়।তবে গবেষকদের মতে বর্তমান ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলের অধিবাসীরা 350 থেকে 550 সালের মধ্যে মাদাগাস্কারে পূর্ণাঙ্গ বসতি গড়ে তোলে।
সপ্তম শতকে আরব এবং পারস্যের বণিকেরা এই দ্বীপটি প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে এবং 1000 সালের দিকে আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড থেকে বিপুল পরিমাণে অভিবাসী মাদাগাস্কারে আসতে শুরু করে।বর্তমানে মাদাগাস্কারের জনগন মালাগাসি হিসেবে পরিচিত। এছাড়া মাদাগাস্কার প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষার নামো মালাগাসি। তবে মাদাগাস্কার দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ফরাসির ভাষার ও প্রচলন রয়েছে। মাদাগাস্কার দ্বীপটির আয়তন 5 লক্ষ 87 হাজার বর্গকিলোমিটার।আয়তনের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের চেয়ে চার গুণ বড়। বাংলাদেশের চেয়ে মাদাগাস্কারের আয়তন বেশি হলেও দ্বীপটিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ মানুষ বসবাস করে। মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা প্রায় 2 কোটি 70 হাজার। এই দেশের অধিকাংশ লোক তাদের স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসের অনুসারী। বাকিরা খ্রিস্টান ধর্ম পালন করে এবং অল্প সংখ্যক মুসলিম ধর্মের লোক এখানে বসবাস করে। মাদাগাস্কারের মুদ্রার নাম মালাগাসি আরিয়ারি । বাংলাদেশি এক টাকা সমান প্রায় 44 আড়ি আড়ি।একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ার কারণে মাদাগাস্কারের সাথে অন্য কোন দেশের কোন সীমান্ত নেই । দিপটি মোজাম্বিক চ্যানেলের মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক হয়েছে । বেনিসিও পর্যটক বণিক মার্কো পোলো মাদাগাস্কারের নামকরণ করেন। ইউরোপীয়দের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম মাদাগাস্কারের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে এ দ্বীপটি সম্পর্কে অবহিত করেন। এরপর পনেরশো সালের শুরুর দিকে পর্তুগিজরা এদিকে আসতে শুরু করলেওপরবর্তীতে ফরাসিরা মাদাগাস্কার দ্বীপ দখল করতে সক্ষম হন। 17 এবং 18 শতকে মাদাগাস্কার জলদস্যুদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার হতো। এবং উনিশ শতক পর্যন্ত এই দ্বীপটি দাস ব্যবসার একটি অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। 16 থেকে 19 শতকের শেষ পর্যন্ত মাদাগাস্কার কিংডম অফ ই মেরিনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের শাসনামলেই বহু ইউরোপীয় উপনিবেশিক এই দেশে আসলেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। তবে 1883 সালে ফরাসিরা মাদাগাস্কারে আক্রমণ চালায় এর 13 বছর পরে 1896 সালে উপনিবেশিক শক্তি মাদাগাস্কারের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে দীপ্তি কে ফরাসি উপনিবেশ হিসেবে ঘোষণা করে। তারও বহু বছর পরে
1946 সালে মাদাগাস্কার ফ্রেন্স ওভারসিজ টেরিটরি হিসেবে গৃহীত হয়।
কিন্তু তারপরও এ দ্বীপের বাসিন্দারা ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করতে থাকে। 1947 সালে ফরাসিরা মাদাগাস্কারের এক এক সশস্ত্র বিপ্লব কঠোর হাতে দমন করতে সফল হলেও তারপরে খুব বেশিদিন ফরাসিরা অঞ্চলে টিকতে পারেনি। পরবর্তীতে 1960 সালে মাদাগাস্কার ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
মাদাগাস্কারের নিজস্ব সমৃদ্ধ বাস্তুসংস্থানের কারণে বিজ্ঞানীরা এই দ্বীপটিকে পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জীববৈচিত্রের প্রাচুর্যতার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর 17 টি দেশকে মহা বৈচিত্র্যপূর্ণ তকমা দেওয়া হয়েছে। মাদাগাস্কার সেই মহা বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি।
মাদাগাস্কারের সিংহভাগ উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।মানব বসতি শুরু হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মাদাগাস্কারের 80 শতাংশ বনভূমি বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে মাদাগাস্কারের প্রাপ্ত প্রায় আড়াই লক্ষ বন্যপ্রাণী 70 ভাগই পৃথিবীর অন্য কোন অঞ্চলে পাওয়া যায় না । শুধু তাই নয় মাদাগাস্কারে 14000 প্রজাতির বৃক্ষের ও 90 ভাগই শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই জন্মে। শুধুমাত্র মাদাগাস্কারে পাওয়া যায় এমন বনানী গুলোর মধ্যে লেমুর অন্যতম ।2012 সালের হিসেব অনুযায়ী মাদাগাস্কারে প্রায় ১১২ প্রজাতির লেমুর বাস করে বাস করে
ব্যাপকহারে বন উজাড়ের কারণে বৃহদাকার লেমুর সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে।
এবং লেমুরের বহু পজাতি আজ বিপন্ন প্রাণী । মাদাগাস্কারে প্রচুর পরিমাণে গিরগিটি দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় পৃথিবীর অর্ধেক গিরগিটি এই দ্বীপেই বাস করে। মাদাগাস্কারে প্রাপ্ত বিভিন্ন বৃক্ষের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাওবাব গাছ। বাওবাব গাছের 9 টি প্রজাতির মধ্যে 6 টি প্রজাতি মাদাগাস্কারে দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছগুলো প্রায় 98 ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে বাওবাব গাছ এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে।
মাদাগাস্কারের কৃষি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভ্যানিলা লবঙ্গ কফি ও লিচু ।বিশ্বের অধিকাংশ ভ্যানিলা ও লবঙ্গ মাদাগাস্কার থেকেই সরবরাহ করা হয়।
মাদাগাস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থকরী আরো একটি পণ্য হচ্ছে চিংড়ি । এছাড়া বর্তমানে পৃথিবীর অর্ধেক স্যাফায়ার বা নীলকান্তমণি মাদাগাস্কার থেকে আসে।এ দ্বীপটিতে নীলকান্তমণি ছাড়াও আরো বহু মূল্যবান পাথর পাওয়া যায়।আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী মাদাগাস্কারে মূল্যবান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আরো রয়েছে নিকেল ও কোবাল্ট ধাতু। মাদাগাসকারের রাজধানীর নাম আনতানানারিভো।এটি মাদাগাস্কারের সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল শহর ।এই শহরটিতে প্রায় 20 লক্ষ লোক বসবাস করে । মাদাগাস্কারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এই আনতানানারিভো শহরটি।
ষোলো ষো 25 সালে রাজা আন্দ্রিয়ানাজাকা এই শহরটি গড়ে তোলেন। আনতানানারিভো অর্থ হাজারের শহর। এমন নামকরণের কারণ হলো, রাজা আন্দ্রিয়ানাজাকা আমলে 1000 সৈন্য সবসময় এই শহরটিকে পাহারা দিত।মাদাগাস্কার তুলনামূলক অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ এদেশের শতকরা 70 ভাগ লোক দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বেয় মাত্র
1 ডলার এর ও কম।
দরিদ্র এই দেশটি পৃথিবীর অসুখী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট 2019 অনুযায়ীমাদাগাস্কার বিশ্বের 14 তম অসুখী দেশ এ দেশের দারিদ্র ও অসুখী জীবনযাপন এর বিপরীতে বিলাসবহুল পর্যটন দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে
মাদাগাস্কারের নজি আশঙ্কাও ও মিয়াভানা এই দ্বীপ দুটিতে গড়ে উঠেছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল পর্যটন ব্যবস্থা ।মিয়াভানা দ্বীপটিতে কোন নৌপথে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই । এখানে শুধুমাত্র হেলিকপ্টারে চড়ে যাওয়া যায়।দীপ দুটিতে ভ্রমণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও ভারত মহাসাগরের অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক এখানে ভিড় করে মাদাগাস্কার ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপ হলেও এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ দ্বীপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপ টি হচ্ছে আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত গ্রিনল্যান্ড
0 মন্তব্যসমূহ